সময় কিছু ভুলতে নই, বাস্তব শিক্ষা দিয়ে বুঝতে ও বড় হতে সাহায্য করে। সময়ের প্রয়োজনে সময় অবস্থার পরিবর্তন করে মাত্র। আমরা আমাদের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, পরিবেশ, সমাজ বা বাস্তব পরিস্থিতি থেকে জীবনের প্রয়োজনে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাই। এ সব শিক্ষাই আমাদের জীবনকে সামনে এগিয়ে যাবার পথের সম্বল। সময় আসলে আমাদের সব চেয়ে বড় এবং পরম শিক্ষক। সময় বলে দেয় কোথায়, কখন, কেন বা কিভাবে আমাকে কোন কাজটি করতে হবে। সময়ের বাস্তব শিক্ষা আমরা বিনা মুল্যে নিই। কিছু কষ্ট, কিছু স্মৃতি, ভালো লাগা, সুখের কথা, ব্যাথা বা বাস্তবতা আসলে সময়ের দেয়া দাগ মাত্র।
সময় আসলে আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল। একই সময়ে যখন আমার দূর্দিন তখন আপনার বা অন্য কারো সুদিন, তাই সময় আপেক্ষিক। আজ আমি সমাজে মাথা উঁচু করে চলছি কিন্তু আপনার অবস্থা অস্বচ্ছল। কারও বাড়ীতে কোন নবজাতকের জন্মে আনন্দের ছড়াছড়ি। আবার কোন বাড়ীতে পরিবারের কারো মৃত্যুতে কান্না ও শোকের ছায়া ইত্যাদি একই সময়ের আপেক্ষিকতা। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের একটি মুখ্য ভুমিকা আছে। সময় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বাস্তব শিক্ষক। কর্মজীবি বা বেকার, ধনী অথবা গরীব, সুখ, দুঃখ সব কিছুই সময় এর প্রতিচ্ছবি। অনেকেই নিজের অবস্থার জন্য সময়কে দায়ী করে। আসলে এমন দাবী কিন্তু অযৌক্তিক নই।
মনে করি কোন প্রতিষ্ঠানে এক কর্মচারী চাকুরী করে। আস্তে আস্তে সে তার যোগ্যতা বলে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী দক্ষ হয়ে উঠল। এক সময় প্রতিষ্ঠানের মালিকও তাকে ভালো জানতে শুরু করলেন। মালিক তাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করেন। অতি বিশ্বাসের কারণে তিনি সিন্ধুকের চাবিও তার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত। এমন ভাবে বেশ ভালই চলছিল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল ছেলেটি আর সে প্রতিষ্ঠানে নেই। সেই সাথে কর্মচারীদের বেতন দেবার জন্য সিন্দুকে রাখা পনের লক্ষ টাকাও নেই। অনেক চেষ্টা করেও নাম ঠিকানা না থাকায় তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে মালিকটির বুকে কষ্ট নিয়ে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না।
অনেক কষ্টে হয়তো মালিক এ ধোঁকা সহ্য করে সুস্থ আছেন। এরপর তিনি অনেক চেষ্টা করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক গতি ফিরে এনেছেন। আবারও কর্মচারীদের মধ্যে একজন তার কাজ কর্ম এবং দক্ষতা দিয়ে তার বিশ্বস্ত হবার চেষ্টা করছে। গত দূর্ঘটনায় সময় মালিককে যা শিখিয়েছে তা বুঝে এবার নতুন এ কর্মচারীকে মালিক বেশী প্রশ্রয় দেননি। ফলে তিনি দ্বিতীয়বার নিজ ব্যবসা বা জীবনে একই দুর্ঘটনা ঘটা থেকে বেঁচে গেছেন। এখানে সময় তাকে পুর্বে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা ভুলতে দেয়নি যার ফলে তিনি আসল সত্যটি বুঝতে পেরেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের দ্বিতীয় বার ক্ষতি হয়নি। বরং সময়ের বাস্তব শিক্ষার ফলে তিনি ব্যবসায় লাভ করেছেন।
অন্য একটি উদাহরণে, প্রসঙ্গ ধনীর ঘরের একমাত্র ললনা! রুপে গুণে দশজনের মধ্যে সে কারও চেয়ে কম নই। বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়ার সময় দুই ক্লাস উপরের এক নম্র ভদ্র সুদর্শন ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। ছেলেটির সাথে এ পরিচিতি ধীরে ধীরে ঘনিষ্ট রূপ নিয়ে প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। ছেলেটির প্রতি মেয়েটির আস্থা এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে ছেলেটিকে সে অন্ধের মত বিশ্বাস করত। ধনীর দুলালীর সরলতা এবং বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে একদিন সে সময়, সুযোগ এবং স্থান বুঝে মেয়েটির সম্ভ্রম নষ্ট করলো। পরবর্তীতে সে কৌশলে মেয়েটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো। এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটির সব হারিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে বিচার দেয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
উপরের উদাহরণে মেয়েটি সতীত্ব হারিয়ে, ধোঁকা খেয়ে মর্মাহত হলেও সময়ের কাছ থেকে একটি কঠিন শিক্ষা পেয়েছে। এ শিক্ষা তাকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন করেছে। তার জীবনে আবার নতুন করে একটি ছেলে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছে। এবার কিন্তু মেয়েটি, ছেলেটিকে কোন পাত্তাই দেয়নি। উপরোন্ত বাবা মার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে, তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে মেয়েটির জীবনে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়েছে। এখানে সময় তাকে ভালো মন্দ বুঝতে শিখিয়েছে। ফলে বাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনে আবার দূর্ঘটনা ঘটার পথ বন্ধ করতে পেরেছে। এ ভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময় আমাদের শিক্ষা দেয়।
সময় বাস্তবতায় হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে আমাদের সতর্ক করে গড়ে তোলে। আর তার ফলে আমরা যদি ভবিষ্যতের সমস্যা থেকে মুক্তি পাই, তবে সেটাকে এক অর্থে বড় হওয়াও বলে। সুতরাং সময় আমাদের বড় শিক্ষক হিসেবে কিছুই ভুলতে দেয় না। আমরা জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকের কাছ থেকে তাত্ত্বিক ও বাস্তব ভিত্তিক শিক্ষা পাই। একই ভাবে সময়ও আমাদের পরিবেশ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বাস্তব শিক্ষা দেয়। মানুষ আর সময়ের শিক্ষার মধ্যে বড় পার্থক্য হলো, সময় কোন তাত্ত্বিক শিক্ষা দেয় না, আর মানুষ ইচ্ছা করলেই যে কোন বিষয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষা দিতে পারে।
পদে পদে কঠিন পরিস্থিতি সামনে এনে সময় আমাদের বুঝতে সাহায্য করে। এ বুঝতে পারার কারণে আমরা একই ভূল বার বার করি না। ফলে জীবনে জটিলতা ও দূর্ঘটনা কমে যায়। ধরুন, কারও একান্ত প্রিয়জন ভূল বুঝে দূরে সরে গেল। এ ক্ষেত্রে সে কিন্তু সরাসরি তার প্রিয়জনকে দায়ী করবে। তাকে স্বার্থপর ও সুযোগ সন্ধানী হিসেবে ধরে নেবে। আবার কোন আপনজনের অকাল মৃত্যুতে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করি। আগে গরীব ছিলাম বর্তমানে ধনী, এমন অবস্থার জন্য আমরা ভাগ্যের প্রশংসা করি। জন্ম-মৃত্যু, উত্থান-পতন, ভাল-মন্দ, ধনী-গরীব ইত্যাদি গভীর চিন্তার বিষয়। গভীর ভাবে চিন্তা করলে, এ সবের জন্য সময়কেই দায়ী মনে হবে।
পরিস্থিতি খারাপ হলে বা কোন দূর্ঘটনা ঘটলে আমরা সাধারণত ব্যক্তিগত ভাবে কারো উপরে দোষ চাপিয়ে দেই। ভাগ্য বা কপালের ভালো মন্দে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার ইশারা আছে। তারপরও কারো উপরে দোষ চাপাতে পারলে আমরা অনেকটা নিশ্চিত হই। ধরুন কেউ পরিশ্রম করে পড়াশুনা করে পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করলো। তার বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাই খুব খুশি। তাদের অনেকেই বলবেন, সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিল তাই ভালো রেজাল্ট করেছে। মানছি তাদের কথায় যুক্তি আছে কিন্তু সব টুকু নই। এ ক্ষেত্রে ছেলেটি সময়ের মুল্য দিয়ে যে কঠোর পরিশ্রম করেছে, সেটিও তার ভালো রেজাল্টের জন্য অনেকাংশে দায়ী। অর্থাৎ ছেলেটি সময় থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
তবে এ ক্ষেত্রে সময়ের একটি সীমারেখা ও বড় ভূমিকা আছে। পরীক্ষার জন্য বছরের হিসাব না হয়ে যদি তিন মাস হতো তবে ছেলেটির নিশ্চয় এমন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট হত না। এখানে সময়ের ভূমিকা এবং সীমাবদ্ধতা প্রধান। পরিশ্রমের সাথে এবং একই সাথে সাথে ছেলেটি সময়ের উত্তম ব্যবহার করেছে মাত্র। তাই আজ সে ভাল ফলাফল লাভ করতে পেরেছে। সময়ের শিক্ষাকে ছেলেটি সঠিক ব্যবহার করেছে। সময় যদি ছেলেটির মাথায়, সময় মাত্র একটা বছর, এ কথা বার বার মনে করিয়ে না দিত তবে তার এমন সাফল্য অর্জন ছিল অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সময় পরীক্ষার কথা ভূলতে না দিয়ে সাফল্যে সহায়তা করেছে মাত্র।
তাই জীবন গঠনে সময়ের ভুমিকা অগ্রগণ্য। আপনি জীবনে যা কিছুই করেন না কেন। সব কিছুতেই সময় নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের বর্তমান সাফল্য বা ব্যর্থতার জন্য প্রাথমিক ভাবে সময় দায়ী। পরবর্তী পর্যায়ে আসে আমাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতা। সময়কে বা সময়ের শিক্ষাকে যদি আমরা সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারি তবে সব ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন সম্ভব। এক বাক্যে বলা চলে সময় আমাদের জীবনে সব চেয়ে বড় এবং নিঃস্বার্থ শিক্ষক। সময়ের শিক্ষার সঠিক অনুধাবন আপনাকে আমাকে আগামীর কাজ গুলো যথাযথ ভাবে করার কৌশল শেখায়। তাই সময় জীবনে কিছু ভুলতে নয়, বুঝতে ও বড় হতে সাহায্য করে।
অনেক ভালো লিখেছেন, আপনাকে ধন্যবাদ।