বিধবা নারীকে আমাদের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা অবজ্ঞা, অবহেলার চোখে দেখে। কিন্তু একজন বিপত্নীক পুরুষকে নির্দোষ ভাবে। নারীকে অপরাধী এবং পুরুষকে ধোঁয়া তুলসি পাতা বানানোর এই চেষ্টা সামাজিক অব্যবস্থা এবং কুসংস্কারকে নির্দেশ করে। প্রাচীন কাল থেকে এ অনাচার চলে আসছে। বর্তমান সমাজে আজও একই চিত্র দেখা যায়। ১৮২৯ সালে রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের ফলে তৎকালীন গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক আইন করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন। কিন্তু আজ প্রায় ১৯২ বছর পরও নারী ভাগ্যের বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। আগে তাদের পুড়ে মরতে হতো, এখন তিলেতিলে মরছে! সতীদাহ, সহমরণ বা অনুমরণ না থাকলেও বর্তমানে বিধাবা নারীদের জীবন বিড়ম্বণা একটি স্বাভাবিক চিত্র।
ধর্মীয় কুসংস্কারপন্থী সুবিধাবাদী স্বার্থপর মানুষদের স্বার্থপরতা বহু যুগ আগে থেকেই ছিল, বর্তমানেও আছে। তাই তারা আধুনিকতার ছদ্মবেশে আজও সক্রিয়। ১৮৩২ সালের সতীদাহ, সহমরণ বা অনুমরণ বন্ধের আইন নারীদের অকাল মৃত্যু রোধ করলেও সব ক্ষেত্রে সফল হয়নি। এসব আইন বিধবা ও নারীদের জীবন রক্ষা করলেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে পারেনি। প্রায় দুই শতকের ধর্মীয় কুসংস্কার আগে ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের চিত্র। এখন ধর্মীয় গোঁড়ামী সব ধর্মের মধ্যেই দেখা যায়। আঠারোর দশকে কতিপয় গোঁড়া পুরোহিতরা বিধবা বিবাহের ঘোর বিরোধী ছিল। আজ আমরা সকলেই বিধবাদের ঝামেলা মনে করি এবং তাদের বাঁকা চোখে দেখি। তবে সংকীর্ণ মানসিকতার উর্ধ্বেও অনেকেই আছেন, তারা সংখ্যায় নগণ্য।
দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময়ই মায়ের ভালবাসা প্রবল, অপরিসীম এবং অতুলনীয়। বিভিন্ন সামাজিক চিত্রে দেখা যায়। শুধুমাত্র সন্তানকে মানুষ করার জন্য অনেক বিধবা জীবনের তৃপ্তি ও চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। পক্ষান্তরে একজন বিপত্নীক পুরুষ হিসেবে জীবনের তৃপ্তিকে বেশী প্রাধান্য দেন। বিপত্নীককে ছাড় দেবার ক্ষেত্রে সামাজের প্রশ্রয় খুবই বেশী। পুরুষের ক্ষেত্রে খুব কম সংখ্যাক ব্যতিক্রম আছে, তারা সন্তানকে মানুষ করার বিষয়টি প্রাধান্য দেন। অনেক বিপত্নীক আজকাল সন্তানদের মুখ চেয়ে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেন না। তারা নিজের সুখের চেয়ে সন্তানকে মানুষ করার বিষয়ে খুবই অনড়। ত্যাগের দিক থেকে হিসেব করলে বিধবা নারী বিপত্নীক পুরুষের চেয়ে অনেক ধাপ এগিয়ে আছে।
ধরুন, একজন ৩২ বছর বয়সী পুরুষের স্ত্রী মারা গিয়েছে। তার দুটো সন্তান আছে। স্ত্রী মারা যাবার দিন থেকেই তার বিয়ে দেবার জন্য আত্মীয় এবং সমাজের মাথা ব্যাথা শুরু হয়! তাকে আবার বিয়ে দেবার জন্য বিভিন্ন যুক্তি খাড়া করে। যেমন, পুরুষ মানুষ, সারা জীবন একা থাকা ঠিক না! দুটো সন্তানকে নতুন বউ খুব ভালোবাসবে ইত্যাদি ইত্যাদি! মানুষ হিসেবে আমাদের দেহ এবং মন দুটোরই খাবারের দরকার হয়। এ উদাহরণে বিপত্নীকের অন্য মেয়ের সাথে গল্প করা, ঠাট্টা বা হাসি তামশা করাকে আমাদের সমাজ এবং পক্ষপাতিত্বের মানসিকতা প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখে। আমরা সবাই শুধু সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকি কখন তাকে বিয়ে দিবো!
আসুন এবার ধরি, একজন ৩২ বছর বয়সী স্ত্রীর স্বামী মারা গেছেন। তারও দুটো সন্তান আছে। স্বামী মারা যাবার পর তার স্বামীর আত্মীয় স্বজন চাইছেন আপদটা সন্তান দুটো নিয়ে বিদায় হোক। বাপের বাড়ীতে চলে যাক। তারা মনে মনে ফাঁদ পাতছে, কি ভাবে, মৃতের আত্মীয়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তি গ্রাস করবে। বিধবা মেয়েটা শত কষ্টেও সন্তান দুটোকে বুকে আগলে রেখে স্বামীর ভিটায় থাকতে চায়। কিন্তু স্বামীর আত্মীয় এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাকে সেভাবে থাকতে দিতে নারাজ। পুরুষের বেলায় হাজারো ছাড়। আর মেয়ের বেলায় পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে নেই। পরিবার, পাড়া, প্রতিবেশী, সমাজ সবাই উঠে পরে লাগবে হাজারো কুৎসা রটাতে।
স্বার্থের কারণে রটানো কুৎসায় পরিবার তো দুরের কথা নিজের সন্তানরা পর্যন্ত ভুল বোঝে। এমনই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। বিপত্নীক পুরুষরা বাজারে গনিকাদের কাছে গিয়ে দৈহিক কামনা বাসানা নিঃবৃত্ত করলে কোন পাপ নেই, না কোন অন্যায় হয়। আর যেই না কোন বিধবা মেয়ে কারও সাথে একটু হাসি মুখে কথা বলেছে! অমনি মৌমাছির চাঁকে ঢিল ছোঁড়ার মত শুরু হলো তাকে পদে পদে অপমান অপদস্ত করার পালা। মেয়েদের কি মন থাকতে নেই! একই মায়ের পেটে মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়ে কি তারা বিরাট অপরাধ করেছে? আমার এ প্রশ্ন সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার কাছে, এ সমাজের সকল মানুষের কাছে। মানুষের প্রতি, মনুষ্যত্বের প্রতি এটাই কি সুবিচার!
সাম্যবাদে বিশ্বাসী হোন। হোন মানব ধর্মে শ্রদ্ধাশীল। আজ এ আধুনিক যুগেও সেই প্রাচীন কালের মত মা, মেয়ে এবং বিধবা এর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। আজও সে অন্যায়ের ধারা অব্যাহত আছে। যুক্তি হিসেবে ধরলে সতীদাহ প্রথা যেমন ছিল তেমনি সৎদাহ প্রথাও প্রাচীনকাল হতে চালু থাকা উচিত ছিল। আমরা কেউই বিল ফেঁটে এ পৃথীবিতে আসিনি। আমাদের এ পৃথিবীতে আসার একমাত্র মাধ্যম হলো মা। তাই একজন নারী বা বিধবা কে যথাযথ সম্মান করা উচিত। মান, সম্মান, লজ্জা, কামনা বাসনা পুরুষ হিসেবে আমার বা আপনার যেমন আছে তেমনি একজন নারীরও আছে। সুতরাং ধর্মের দোহায় না দিয়ে নিজের বিবেকের সাম্যবাদ প্রয়োগ করা আমাদের সবারই উচিত।