পরামর্শ সবাই দেবে, গ্রহণযোগ্যতা বিবেকের কাছে। পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে লোকের অভাব নেই। আপনি কোন সমস্যা বা খারাপ পরিস্থিতিতে পরে দেখুন! হাজারো জন হাজারো যুক্তি এবং পরামর্শ নিয়ে আপনার সামনে হাজির হয়েছেন। পরামর্শ দেয়ার এ কাজে শতকরা নিরানব্বই জনই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মজার বিষয় হলো, প্রায় সবগুলো পরামর্শই আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হবে। সবাই যেন সুযোগে আপনার ক্ষতি করার জন্য ওত্ পেতে আছে। সবাই যেন একজনের ক্ষতি করার জন্য অস্থির! এমন তো নই, আপনার ক্ষতি করলে সবার বিশেষ লাভ হবে। এর মধ্যে দু একজন তো অনেক কৌশল করে আপনাকে পরামর্শ দেবেন যাতে আপনি আরও বিপদে পড়েন।
যারা পরামর্শ দেন, তাদের প্রায় সবারই লক্ষ্য থাকে, এ থেকে লাভবান হবার। তাই তারা উপযাচক হিসেবে পরামর্শের পশরা সাজিয়ে বসেন। প্রত্যেকের পরামর্শ শোনার সময় আপনার মনে হবে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ আর হয় না! কিন্তু আপনার অবস্থা বিচারে আপনি সর্বেচ্চ দুটি ভাল পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। যার একটি আপনার কাজে প্রয়োগ করবেন। অপরটি বিকল্প প্রয়োগর জন্য তোলা থাকবে। অনেকের কাছ হতে শোনা পরামর্শের মধ্যে ভাল টি বেছে নিন। এ ক্ষেত্রে ভাল পরামর্শটি বেছে নেয়া আপনার পক্ষে অনেক কঠিন হবে। এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমস্যায় পড়লে আমরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
কারণ এরই মধ্যে আপনি সমস্যার কারণে অনেকটা মানসিক বিপর্যস্ত। তাই আপনার সমস্যা থেকে বের হবার জন্য সার্বিক দক্ষতার দরকার। সব দিক বিবেচনা করে আপনার সঠিক পরামর্শটি প্রয়োগ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সমাজে অনেকেই সময় সুযোগ পেলেই অন্যকে বিভিন্ন বুদ্ধি দিয়ে থাকেন। আপনি যদি তাদের প্রশ্ন করেন। আপনি যে পরামর্শ আমাকে দিলেন তা কি বাস্তবে আপনি প্রয়োগ করেছেন? এ ক্ষেত্রে তিনি উত্তরে আপনাকে হাঁ বা না বলবেন। এতে আপনার কাছে আসা পরামর্শগুলো বাছাইয়ে অনেকটা সুবিধা হবে। আসলে আমি মানি না বা করিনি এমন পরামর্শ বা উপদেশ আমি ইচ্ছে করলে অনেককেই দিতে পারি। কিন্তু সঠিক উপদেশ আমরা খুব কমই দিই।
উপদেশ দেবার ক্ষেত্রে কোন খরচ নেই বা ট্যাক্সও দিতে হয় না। যদি প্রতিটি কথা বা পরামর্শের পেছনে সামান্য ট্যাক্স বসানো হতো। তবে বুঝা যেত, কে কাকে কতটা পরামর্শ দিতে পারে। যেহেতু উপদেশ বা পরামর্শ দিতে খরচ হয় না। তাই আমরা বাঙ্গালীরা অন্যকে এই একটি জিনিসই বেশী দিতে পারি। অনেকটা বিপদে পরে আবার অনেকটা, বাঙ্গালী ফ্রি পেলে আলকাতরাও খায়, এমন অবস্থায় আমরা সবার পরামর্শই খুব মনযোগ দিয়ে শুনি। এমন না হলে আমরা কারও উপদেশই শুনতাম না। বিপদে আমাদের বিবেকের কাছে যা সঠিক মনে হবে আমরা তাই গ্রহণ করি। সমস্যায় পড়লে নিজের কাছে যে পথ সহজ তা গ্রহণ করা ভালো।
এর ফলে আপনার ক্ষতি হলেও, নিজের দোষে ফকির হয়েছেন। এ কথা ভেবে মনে একটু হলেও শান্তি পাবেন। আমরা যা কিছু করি তার বেশীর ভাগই নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে করি। কদাচিৎ কোন কাজ, পরামর্শ বা উপদেশ অন্যের ভালো হবে ভেবে করি। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। সব চেয়ে বড় কথা হলো। কেউ কোন কারণে সাহায্য না চাইলে আগ বাড়িয়ে কাউকে পরামর্শ দিতে নেই। এতে নিজের ব্যক্তিত্ব বা সম্মানহানি হয়। তবে কেউ সমস্যা বা বিপদে পড়ে সাহায্য চাইলে তাকে অবশ্যই পরামর্শ দিতে হবে বা সাহায্য করতে হবে। এখানে আমি অতি উৎসাহী হয়ে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকাকে নিষেধ করছি।
একটা কথা না বললেই নই তা হলো, কেউ যদি খারাপ চরিত্রেরও অধিকারী হয়। এখানে তার বিবেক যা করতে বলবে, সেটাও কিন্তুু সঠিক। মানবতার প্রশ্নে তা কল্যাণকর নাও হতে পারে। যেমন, দুইজন পাকা চোর একজন চোরকে উপদেশ দিচ্ছে, চুরি করার সময় গায়ে শরিষার তেল ভালো করে মাখবি। আর একজন বলছে, না শরিষার তেলের দাম বেশী দরকার নাই এসবের, তুই গায়ে কলাগাছের রস মাখবি! এখানে নতুন চোরের বিবেক যা বেছে নিক না কেন। সে কিন্তু কোন এক গৃহস্থের ক্ষতি করার জন্য সিঁদ কাটতে যাচ্ছে। অতএব বিবেক সায় দিলেই যে সেটা অন্যের জন্য মঙ্গলের হবে এমন কোন কথা নেই।
পরামর্শের ক্ষেত্রে আসলে কোন বাধা ধরা নিয়ম বা রীতি নীতি নেই। সবাই হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতিতে আপনাকে পরামর্শ দেবেন। যে পরিস্থিতি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সঠিক ভাবে কাজ করা আসলেই একটা বড় চ্যালেন্জের বিষয় হয়। আজ আপনি যে সমস্যায় পরে অনেকটা দিশেহারা ঠিক সে একই পরিস্থিতিতে পরলে আমি হয়তো পাগল হয়ে যেতাম। আমি এখানে আক্ষরিক অর্থে পাগল বুঝাইনি, আচরণটা বুঝিয়েছি মাত্র। তাই জটিল পরিস্থিতিতে কার পরামর্শে যে আপনার ভালো হবে তা বিচারের ক্ষমতাটা ঠিক সে মুহুর্তে কমে যায়। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে যেমন আমরাই নাজুক পরিস্থিতিতে পরি।
উপরে বর্নিত জটিল পরিস্থিতিতে। কার দেয়া পরামর্শে আপনি সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন সে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। সমাজে যারা পরোপকারি, বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান তারা সচরাচর এমন পরিস্থিতে সিদ্ধান্ত নিতে অবশ্যই সাহায্য করবেন। একই সাথে তারা সম্পুর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব সময় আপনার সাথে থাকবেন। আপনার বিপদে যিনি সৎ এবং সঠিক পরামর্শ দিয়ে খারাপ পরিস্থিতি থেকে বের করে এনেছেন। তিনিই একজন সঠিক পরামর্শ দাতা। সমাজে এ জাতীয় লোকগুলো পরোপকারী হিসেবেই পরিচিত। তবে পরিবার পরিজন আবার তাদের অনেককেই অকর্মা বলে নিন্দা করে থাকেন। তারপরও তারা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভাল মানুষ। যোগ্যতা এবং মানবিকতা বিচারে তারাই প্রকৃত প্রশংসার দাবীদার।
ধরি আপনার পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে নেয়ার জন্য একটা যানবাহন প্রয়োজন। যিনি পরামর্শ দিলেন আবার দৌড়ে গিয়ে গাড়ী নিয়ে আসলেন। রুগী এবং আপনার সাথে থেকে তৎক্ষনাৎ ধার হিসেবে ডাক্তারের ফি অথবা গাড়ীর ভাড়া পরিশোধ করলেন। এখানে তিনি সঠিক পরামর্শ প্রদানকারী তো বটেই সাথে পরোপকারী হিসেবেও বিবেচিত। আবার আপনার দুই ভাই এর পারিবারিক সাধারণ বিবাদে কেউ হয়তো সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে বসে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়তো পরিস্থিতি বিচারে সঠিক পরামর্শ দান কারী। পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে যিনি আপনাকে সব ধরনের সাহায্য করেছেন তিনিই সঠিক উপদেশ দাতা।
আমাদের জীবনের বেশীর ভাগ সমস্যাতে অর্থের একটি সম্পর্ক আছে। এই যে হাজারো পরামর্শ দাতা আপনাকে বিনা পয়সায় এতো এতো পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা যদি পরামর্শের পরিবর্তে আর্থিক ভাবে আপনাকে একটু সহায়তা করতো। তবে আপনার সমস্যাটা কিন্তু সমাধান হয়ে যেত। তারা আসলে তেমনটা করবেন না। কারণ নিজের লাভ, সুবিধা ইত্যাদি বিষয়গুলো আমরা সবাই খুব ভালো এবং আগেই বুঝি। সুতরাং যা দিলে নিজের আর্থিক ক্ষতি নেই সে দিকে বরাবরই আমাদের ঝোঁক বেশী। ঠিক এ কারণেই আমরা অপরকে বিনা স্বার্থে দেবার মত উপদেশকে উদার হয়ে দিই। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা আসলে লাভ ক্ষতির ব্যাপারে খুবই সচেতন।
অনেকে অনেক কথা বলবেন বা পরামর্শ দেবেন। সম্ভব হলে আপনি সবই শুনবেন। কিন্তু গ্রহণ করবেন সেটা, যেটা সর্বাপেক্ষা উত্তম, বাস্তব সম্মত এবং যা করতে আপনার বিবেক সায় দেয়। একই সাথে কারও নিকট হতে নেয়া পরামর্শে আপনার উপকারের সাথে সাথে অন্য কারও যাতে ক্ষতি না হয়। সে দিকে খেয়াল রাখাও আবশ্যক। সব সময়ই নিজের বিচক্ষণতা এবং বিচার বুদ্ধি দিয়ে অতি সহজেই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা যায়। এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আর সব ক্ষেত্রে নিজে উপযাচক হয়ে পরামর্শ দেয়া ত্যাগ করতে হবে।